লজ্জা মুমিনের ভূষণ

প্রকাশিত: ৭:৫০ অপরাহ্ণ , জুন ১৮, ২০২০

মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সেরা বানিয়ে কিছু স্বভাবজাত সৌন্দর্য তার মধ্যে দিয়েছেন। এই গুণগুলোর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল লজ্জা। ইসলামে এর খুব গুরুত্ব।

ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এক আনসারির কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে অপর এক ব্যক্তিকে লজ্জা সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছিলেন।

তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তাকে ছাড়ো! কেননা লজ্জা ঈমানের অংশ।’ (আল জামিউ বাইনাস সাহিহাইন, হাদিস : ১২৭৩)

হজরত যায়েদ ইবনে তালহা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক ধর্মের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। ইসলামের বৈশিষ্ট্য হল লজ্জাশীলতা।

লজ্জা এবং ঈমান একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানের গুণ থাকবে তার মধ্যে অব্যশই লজ্জার মতো মূল্যবান গুণও থাকবে। যার মধ্যে লজ্জা থাকবে না তার মধ্যে ঈমানও থাকবে না পূর্ণাঙ্গ।

রাসূল (সা.) বলেছেন, লাজুকতা ও কম কথা বলা ঈমানের দুটি বৈশিষ্ট্য। আর অশ্লীলতা ও বাচালতা মুনাফিকির দুটি বৈশিষ্ট্য।

হজরত ওমর (রা.)-এর ছেলে হজরত আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ঈমান ও লজ্জা এ দুটি ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। যখন এর একটি ছেড়ে দেয়া হয়, তখন অন্যটি এমনিতেই চলে যায়।

নবীজি (সা.) বলেন, লজ্জা এবং ঈমান একটি অপরটির পাশাপাশি বসবাস। যখন একটি ওঠে যায় তখন অন্যটিও ওঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। (মিশকাত)

লজ্জা ইসলামের প্রকৃতি

রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘প্রতিটি ধর্মের একটি বিশেষ স্বভাব আছে। আর ইসলাম ধর্মের বিশেষ স্বভাব হল লজ্জা।’ (মুয়াত্তা মালেক, হাদিস : ৩৩৫৯)

লজ্জা মহানিয়ামত

লজ্জা এক নিয়ামত মহানিয়ামত। পরম সৌন্দর্য। এর দ্বারা পৃথিবীতে শান্তি, নিরাপত্তা লাভ হয়। এ জন্য একজন লজ্জাশীল চরিত্রবান মুমিন বিপুল পরিবর্তন আনতে পারেন সমাজে। শান্তি নিরাপত্তা, কল্যাণের শোভায় শোভাশিত করতে পারেন সমাজের প্রতিটা সেক্টরে।

হজরত ইমরান ইবনে হুসাই (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, ‘লজ্জা শুধু কল্যাণই বয়ে আনে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১১৭)

লজ্জার পুরস্কার

যে কোনো বান্দা লজ্জার গুণ অর্জন করবে তার জন্য ক্ষমা এবং অনেক বড় প্রতিদানের ওয়াদা করেছেন মহান আল্লাহ।

সূরা আহজাবের ৩৫ নং আয়াতে লজ্জাস্থানসহ আরও কয়েকটি গুণের আলোচনা করে বলা হয়েছে ‘আল্লাহ এদের সবার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।’

এ মেহনত ও কামাই বিনষ্ট হয় না মহান রবের দরবারে। রূহানী ও নৈতিক উন্নতি সাধনের অতুলনীয় উপায় মাধ্যম লজ্জাস্থানের হেফাজত।

যে সব নারী-পুরুষ ব্যাভিচার থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখে। সর্বদা মহান আল্লাহর জিকিরে কাটায় আল্লাহ পাক তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং বিরাট প্রতিদানও দেন।

নবীজি (সা.) কুরাইশ যুবকদের লক্ষ্য করে বলেছেন, হে কুরাইশ যুব-জনতা! তোমরা তোমাদের লজ্জাস্থান হেফাজত কর। ব্যাভিচার থেকে বেঁচে থাক। শুনে রাখ, যে লজ্জস্থানের হেফাজত করবে তার জন্য জান্নাত।’

বুঝা গেল লজ্জার বিনিময় জান্নাত। কাজ অল্প তবে পুরস্কার কিন্তু বড়। এ নিয়ামত অর্জন করার চেষ্টা করা চাই, তবে অনেক লাভবান হওয়া যাবে।

লজ্জা গোনাহের প্রতিবন্ধক

আবু মাসউদ বদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষ পূর্ববর্তী নবীদের বাণী থেকে এ কথা জেনেছে যে, ‘যখন তোমার লজ্জা নেই তখন তুমি যা ইচ্ছা তাই কর।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭৬৯)

লজ্জা মানবের ভূষণ

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো কিছুতে অশ্লীলতা তাকে শুধু কলুষিত করে আর কোনো কিছুতে লজ্জা তাকে শুধু সৌন্দর্যমণ্ডিত করে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১২৬৮৯)

লজ্জা প্রতিপালকের গুণ

মহানবী (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যন্ত লজ্জাশীল ও অন্তরালকারী। তিনি লজ্জা ও অন্তরালে থাকতে পছন্দ করেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪০১৪)

পর্দার সীমারেখা

লজ্জার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ গুণ অর্জন করতে হলে মুসলমান নারী পুরুষ সবার পর্দার প্রতি বিশেষভাবে যত্মবান হতে হবে।

শুধু নামে মাত্র পর্দা নয়। পর্দার সর্ব সেক্টরে গুরুত্ব দিতে হবে। চোখের লজ্জা ঠিক রাখতে হলে বেগানা নারীর পুরুষের সরাসরি দেখা সাক্ষাৎ করা যাবে না। খারাপ জিনিস দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। হাত-পায়ের লজ্জা রক্ষা করতে চাইলে খারাপ কাজ করা থেকে নিজের হাত-পায়ের হেফাজত করতে হবে।

অন্তরকে লজ্জাজনক বিষয় হতে বাঁচাতে খারাপ অশ্লীল বিষয় অন্তরে স্থান দেয়া যাবে না। এগুলোর প্রতি খুব যত্মবান হতে হবে। লজ্জার গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলোর প্রতি যত্মবান হলে পুরস্কারের মুকুট পরাবেন মহান আল্লাহ।

নবী হজরত ইউসুফ (আ.)-এর বাদশাহি মুকুট নসিব হয়েছে। কেননা তিনি সর্বদা লাজুকতার পরিচয় দিতেন। যখন হজরত ইউসুফ (আ.)-কে বিবি জুলাইখা গোনাহের প্রতি আহ্বান করল, কিন্তু হজরত ইউসুফ (আ.) জুলাইখার আহ্বানে অস্বীকৃতি জানালেন এমনকি তিনি আল্লাহর আশ্রয় চেয়েছেন। জুলাইখার সামনে নিজের পবিত্রতা এবং ইজ্জত বিলিয়ে দেননি।

তখন মিথ্যা এবং চক্রান্তের জালে ফাঁসিয়ে তাকে জেলে পাঠানো হয়। জেলখানার কষ্টকে তিনি হাসিমুখে বরণ করে নেন। কিন্তু লজ্জা ও অন্তরের পবিত্রতা বিকিয়ে দিতে রাজি হননি।

এ জন্য আল্লাহ পাক তাকে শুধু জেলখানা থেকে বের করেননি বরং তাকে দুনিয়ার ধনভাণ্ডারের মালিক বানিয়েছেন। বানিয়েছেন মিসর অধিপতি।

আমরাও যদি নবী হজরত ইউসুফ (আ.)-এর মতো নিজের ইজ্জত-সম্মানের হেফাজত করতে পারি। গোনাহ-পাপাচার থেকে বেঁচে থাকি। তাহলে আমাদেরকেও ইজ্জত সম্মান ও নিয়ামতের মুকুট পরাবেন মহান আল্লাহ।

শুধু রাজপ্রাসাদ এবং মুকুটই নয় বরং লজ্জাশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অনেক মাকবুল হয়ে যায়। আল্লাহ তার দোয়া ফিরিয়ে দেন না। তাকে বিপদ-মুসিবতে ফেলেন না। সর্বোপরি তাকে সব রকমের সংকট থেকে বাঁচিয়ে আগলে রাখেন।

এ জন্য সব নারীদের পর্দার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষজনকে চুলসহ শরীর দেখানো থেকে বাঁচতে হবে। যখন পর্দার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হবে। তখন বাসা-বাড়ি থেকে আতর-সুগন্ধি মেখে বের হবে না। যুবক ছেলেরাও তার প্রতি আর্কষণ সৃষ্টি হবে না।

হাদিসে এসেছে, যে নারী সুগন্ধি লাগিয়ে ঘর থেকে বের হয়। আর তার নিয়ত যদি এই হয়, সুগন্ধি পরপুরুষকে ছুঁয়ে যাক তাহলে সে নারী ব্যাভিচার করার সমতুল্য কাজ করল।

তাই যে নারী পর্দা এবং লজ্জা-শরমের প্রতি যত্মবান হবে। পশ্চিমাদের অন্ধ অনুসরণে গা ভাসিয়ে দেবে না। তখন তার নিকটের কোনো পুরুষ তো দূরের কথা শয়তানও তার কাছে আসার চিন্তা করতে পারবে না।

যারা পার্থিব জীবনে লজ্জা-শরমের প্রতি গুরুত্ব দেবে এবং সব রকমের কুপ্রবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকবে আল্লাহ পাক তাদেরকে দুনিয়া-আখেরাতে অগণিত নিয়ামতে ভূষিত করবেন। দুনিয়াতে দেবেন ইজ্জত সম্মান আর আখেরাতে করবেন ক্ষমা।

আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে লজ্জার গুণ অর্জন করার এবং বেপর্দা থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ

Loading